Wellcome to National Portal

বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন, জোনাল অফিস, খুলনার ওয়েব পোর্টালে আপনাকে স্বাগতম।

মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

গ্রামীণ আবাসন প্রকল্প

গ্রামীণ আবাসন প্রকল্প

 

 

 

 

গ্রামীণ আবাসন প্রকল্প : আমার একটি স্বপ্ন

           ---  ড. মো. নূরুল আলম তালুকদার

 

 

ব্যাংকিং পেশায় দীর্ঘ কর্মজীবন অতিবাহিত করে ২০১১ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনে যোগদান করি। যোগদানের পর দ্রুত প্রতিষ্ঠানটির সমস্যা ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করে যথাযোগ্য সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করি। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা ও সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে বিএইচবিএফসি‘র উন্নয়ন অগ্রযাত্রা নতুন গতি লাভ করে। গত চার বছরে কর্পোরেশনের গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধিকল্পে ঋণের আবেদনপত্র দ্রুততার সাথে নিস্পত্তি করা হচ্ছে। গ্রাহক হয়রানি বন্ধে কর্পোরেশনের প্রতিটি অফিসে One-Stop-Service Center ও Help-Desk চালু করা হয়েছে। ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় কর্পোরেশনের মাঠ পর্যায়ের অফিস পর্যন্ত কম্পিউটারাইজেশন ও Electronic Database System গড়ে তোলা হয়েছে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, সেবা ও পন্য জনগণের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি জেলায় অফিস স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এবং সিরাজগঞ্জে নতুন অফিস খোলা হয়। কর্মীদের পেশাদারিত্বের মানোন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলসহ নানাবিধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

 

কর্পোরেশনের ঋণ কার্যক্রম শুরু থেকেই প্রধানতঃ রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। মফস্বল ও পল্লী এলাকার মানুষের জন্য গৃহ ঋণের সুবিধা ছিল অতি সামান্য। বিএইচবিএফসি‘র ঋণ সেবা গ্রামমুখী করার লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে চার বছরে শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঋণ বিতরণের ব্যবধানের অনুপাত ৭৪:২৬ থেকে ৫২:৪৮-এ উন্নীত হয়। গ্রামীণ জনপদে ভূমি সাশ্রয়ী ঊর্ধ্বমুখী কমিউনিটি আবাসন গড়ে তোলা আমার দীর্ঘদিনের লালিত একটি স্বপ্ন। সম্প্রতি আইডিবি কর্তৃক ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ সহায়তার জন্য গৃহীত ‘‘Rural Housing Project of Bangladesh’’–প্রকল্পটি  দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি অংশ।

 

কর্পোরেশনে যোগদানের পর ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জার্মান ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত Affordable Housing  ও  Housing Finance বিষয়ক বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদানের সুযোগ হয়। এসব সেমিনার থেকে লব্ধ জ্ঞান ও ধারণা অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের জন্য ব্যয় ও ভূমি সাশ্রয়ী কমিউনিটি আবাসনের একটি মডেল প্রণয়নের চিন্তা করি। এর সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘স্বল্প সুদে গ্রামীণ এলাকায় ঋণ’ প্রদানের নির্দেশনা পাথেয় হিসেবে যুক্ত হয়।

 

উল্লেখ্য, গত ১৯ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখ গোপালগঞ্জে কর্পোরেশনের রিজিওনাল অফিস উদ্বোধনকালে তিনি উক্ত পরামর্শ দেন।  উপস্থিত মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিতও এ বিষয়ে  বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্ভাবনী ধারনা প্রকল্প তৈরীতে আমাকে দারুনভাবে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের প্রয়োজন পূরণে এবং কৃষি জমি রক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে ।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের হাউজিং কনসালটেন্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সাথে মতবিনিময়কালে বাংলাদেশের স্বল্প-আয়ের মানুষের জন্য সরকারের নানা আয়বর্ধন কর্মসূচীর প্রতি বিশ্বব্যাংকের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করি। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে বরাবরই বিশ্বব্যাংকের আর্থিক ও কারিগরী সহায়তাও পেয়ে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সামর্থ ও সার্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ১০০০ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ একটি প্রিলিমিনারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল (পিডিপিপি) তৈরী করা হয়। অতঃপর প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকে  প্রেরণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বা আইএফসি কর্তৃক প্রকল্পটিতে অর্থায়ন বেশি দূর এগোয়নি । 

 

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আমার চিন্তা ও উদ্যোগ থেমে থাকেনি। এ সময় পরিকল্পনা বিভাগের তৎকালীন সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম-এর পরামর্শ অনুযায়ী প্রকল্পটি সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি)-তে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবটি কিছুটা সংশোধন করে প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নিকট একটি পাইলট প্রকল্প জমা দেয়া হয়। এ প্রকল্প মতে প্রথমে দেশের ২২টি উপজেলায় প্রতিটি ৪ তলা বিশিষ্ট ৩৭৫টি ভবনে স্বল্প আয়তনের মোট ৩০০০টি হাউজিং ইউনিট নির্মাণের রূপরেখা তুলে ধরে তা  পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়। প্রকল্প প্রস্তাবটি সরকার কর্তৃক যাচাই বাছাইয়ের পর ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-তে ‘বাংলাদেশে গ্রামীণ গৃহায়নে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা’ প্রকল্প নামে এটি একটি বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রস্তাব হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় (ক্রমিক নং-১৪১)।

 

এডিপি-তে প্রকল্পটি তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং কর্পোরেশনের মধ্যে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম. আসলাম আলম সভাপতিত্ব করেন। এ সভায় সচিব মহোদয়কে চেয়ারম্যান করে প্রকল্পটির ‘পলিসি নির্ধারণ’ এবং আমাকে সভাপতি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের

 

লক্ষ্যে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রকল্পটি পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এর অনুকূলে মোট ৩৭৩.০২ কোটি টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ী প্রকল্পটিতে অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ বিভাগে একটি প্রস্তাবও প্রেরণ করা হয়। দেশীয় অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে এ আশংকা থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দূরদর্শী বিকল্প চিন্তা করে। প্রকল্পটি আর্ন্তজাতিক সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ERD)-এ প্রেরণ করে। ইআরডি বিগত ৫ মে, ২০১৫ তারিখ এটিতে অর্থ সহায়তা প্রদানের সুপারিশ করে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (IDB)-এ প্রেরণ করে।

 

ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) Member Country Partnership Strategy (MCPS) -এর আওতায়  আইডিবির একটি  মিশন গত ১৮-২১ অক্টোবর, ২০১৫ বাংলাদেশ সফর করে। উক্ত মিশন ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে অনুষ্ঠিত সভায় ১৬৯৭.৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ সাপেক্ষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মোট ১৫টি প্রকল্প প্রস্তাবের উপর আলোচনা শেষে তা অনুমোদনের জন্য গৃহীত  হয়। বিএইচবিএফসি’র Rural Housing Project of Bangladesh প্রকল্পটি এর অন্যতম। প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পটির জন্য ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ সহায়তা চাওয়া  হয়।  প্রকল্পটির গুরুত্ব এবং ধারণা IDB’র  নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ায়  সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধি করে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত করে। এ পর্যায়ে প্রকল্প  গ্রহণে সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা এবং আইডিবি’র অর্থায়ন অনুমোদনের শর্ত হিসেবে প্রকল্পটির প্রাক-সমীক্ষা প্রতিবেদন দাখিলের পরামর্শ দেয়া  হয়েছে। প্রকল্পটির প্রাক-সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুমোদিত হলে প্রথম পর্যায়ে দেশের ৬৬টি উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বহুতল কমিউনিটি আবাসন প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে একজন মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা হিসেবে গর্ববোধ করবো। 

 

এ প্রকল্পে একজন গ্রহীতা বার্ষিক মাত্র ৬ শতাংশ সরল সুদে সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকার গৃহঋণ পাবেন। প্রতি ১ লক্ষ টাকার ঋণের বিপরীতে গ্রহীতাকে মাসিক ৭১৭ টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ঋণ প্রতি একজন গ্রহীতার ইকুইটি হবে ঋণের ২০ শতাংশ। এক বছরের গ্রেস-পিরিয়ড ছাড়াও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হবে ২০ বছর। এ প্রকল্পের একজন গ্রহীতা ৫৬০ থেকে ৬৭০ বর্গফুটের একটি ইউনিটের বিপরীতে এ ঋণ পাবেন। প্রকল্পের আঙ্গিনায় দুগ্ধ ও হাঁস-মুরগীর খামার গড়ে তোলার সুযোগ থাকবে। পল্লী এলাকার নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে কোন বাংলাদেশী নাগরিক প্রাথমিকভাবে এ ঋণের জন্য যোগ্য হবেন। ঋণ প্রার্থীর একক বা যৌথনামে এক খন্ড নিস্কন্টক জমি থাকতে হবে।

 

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সূচকে বিএইচবিএফসি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। আর্ন্তজাতিক হাউজিং বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘‘Housing : An Engine for Inclusive growth’’।  প্রকল্পটির মাধ্যমে চাষযোগ্য ভূমি রক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখা, পরিবেশ উন্নয়ন এবং এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এর ফলে ঢাকা শহরে বাড়তি মানুষের চাপ কমবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় পরিকল্পিত আবাসনের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতি, পরিবেশ ও জীবনমানের ক্ষেত্রে এক বিরাট বিপ্লব সাধিত হবে বলেও আমার বিশ্বাস।  

 

বিএইচবিএফসিতে কর্মকালীন সময়ে নিরলস পরিশ্রম এবং Innovative চিন্তা চেতনার মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে সার্বিক উন্নয়ন সূচিত হয়েছে। সেবার মান বৃদ্ধি, ব্যবসা সম্প্রসারণ, সরকারের নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের ফলে কর্পোরেশনের সুনাম ও খ্যাতি দেশ-বিদেশে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিধিবদ্ধ নৈমিত্তিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে থেকে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য বিশেষ কিছু করার মহতী উদ্যোগ ছিল বলেই Rural Housing Project of Bangladesh–এর মতো একটি দৃশ্যমান কর্মসূচী বাস্তবায়নের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। তবে, এ স্বপ্ন সফল করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা আমাকে উৎসাহ, পরামর্শ এবং নানাবিধ টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন, আমি তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে হলে  সরকারী  পৃষ্ঠপোষকতা  আবশ্যক।  এখনই সময় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় হাউজিংকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা। যার ফলে আবাসন খাতের চাহিদা যেমন পূরণ হবে  তেমনি দেশও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে ।

 

 

(ড. মোঃ নূরুল আলম তালুকদার)

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন

অফিস ফটো